শনিবার ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শ্রেয়ার কথা – মাধুরী মজুমদার

  |   শুক্রবার, ০৪ জুন ২০২১ | প্রিন্ট

শ্রেয়ার কথা – মাধুরী মজুমদার

অনুপ্রেরণা মূলক বাস্তব গল্প: মাধুরী মজুমদার

“ডান হাতটা নেই , দমে যাই নি, থেমে থাকিনি বিশ্বাস করি, বাঁ হাতের জোরেই নিজের ভাগ্য নিজে লিখতে পারব আমি।” হ্যা, তিনি আজ স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপিকা। শ্রেয়ার এই লড়াই নিয়ে মারাঠিতে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে ‘জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস’। মুম্বইয়ের কলেজে আর্কিটেকচার পড়ছিলেন তিনি। আজ থেকে ন’বছর আগে, এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলেন কলকাতায়। ভাবতে পারেননি, বিয়েবাড়ির আনন্দ তো বটেই, গোটা জীবনের আনন্দই ফিকে হয়ে যাবে কলকাতা থেকে মুম্বই ফেরার পথে। সালটা ২০১০। বিয়েবাড়ি সেরে ফেরার পথে ট্রেনের আপার বার্থে শুয়েছিলেন তরুণী শ্রেয়া। ক্লান্তিতে ঘুমও এসে গেছিল। আচমকা প্রচণ্ড শব্দ করে ওলোটপালোট হয়ে গেল গোটা ট্রেন। “খুব জোরে পড়ে গেলাম বার্থ থেকে। লাগল ভীষণ। ট্রেনটাও উল্টে যাচ্ছিল। আর কিছু মনে নেই আমার।”– বলেন শ্রেয়া সেন। তবে ওই মুহূর্তটা শ্রেয়ার মনে না থাকলেও, সে দুর্ঘটনার কথা আজও ভোলেননি অনেকেই। ২০১০ সালের ২৮ মে কলকাতা-মুম্বই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়েছিল মেদিনীপুরে। ঝাড়গ্রামের কাছে সরডিহা স্টেশনের ওই ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ১৪৮ জন। তাঁদেরই মধ্যে এক জন বাঙালি তরুণী, শ্রেয়া সেন। হ্যাঁ, প্রাথমিক ভাবে তাঁকে মৃত বলেই মনে করেছিলেন উদ্ধারকারীরা। “আমার যখন জ্ঞান এল, তখন আমি ধ্বংসস্তূপের তলায়। ডান হাতে কোনও সাড় নেই। অনুভব করলাম, গোটা হাতটাই নেই। কাটা পড়েছে। আদতে আমার সারা শরীর রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হলেও, কোথাও কোনও সাড় ছিল না। অবশ হয়ে গেছিল সব কিছু। ওই অবস্থাতেও আমার প্রথম যে কথাটা মাথায় এসেছিল, সেটা হল– আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।”– স্মৃতি ভাগ করে নিচ্ছিলেন শ্রেয়া। আর ঠিক এই জায়গাটা থেকেই গল্পটা শুরু হয়। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। একটা হাত খুইয়েও সফল এক জন আর্কিটেক্ট হিসেবে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়িয়ে নতুন নতুন কাজ করার গল্প। অথচ সম্ভাবনাময় স্থপতির পেশাদার জীবনের স্বপ্নে ইতি হওয়ার কথা ছিল, দুর্ঘটনায় ডান হাত হারিয়ে। কিন্তু এই বাঙালিনি বাঁ হাতেই জীবনের হিসেব পাল্টে দিয়েছেন। নতুন করে বেঁচে থাকার গল্প লেখার সময়ে সেই হাত একটুও কেঁপে যায়নি তাঁর। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকেই শ্রেয়া শুনেছিলেন, তাঁর ১৫ বছরের ভাই সাহায্য চেয়ে ছুটোছুটি করছে রেললাইন ধরে। স্থানীয় মানুষেরা এগিয়ে এসে বার করছেন এক এক জনকে। শ্রেয়া বেশ কয়েক বার চিৎকার করেন, “আমি বেঁচে আছি!” কোলাহল পেরিয়ে সে চিৎকার কানে পৌঁছয় না কারও। এমন সময়ে এক আর্মি অফিসারকে দেখে ফের চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমি বাঁচতে পারব, আমাকে বার করুন প্লিজ়।’’ তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলেন শ্রেয়ার মা-ও। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, মেয়ে নেই। এর পরের পর্বটা আরও যন্ত্রণার। একের পর এক অস্ত্রোপচার চলে বছর পঁচিশের তরুণী শ্রেয়ার শরীরে। কয়েক মাস পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি। বলেন, “কলেজে যোগ দিই আবার। কিন্তু আমি পুরো শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্বপ্ন ছিল আর্কিটেক্ট হওয়ার। ডান হাত ছাড়া সে স্বপ্ন কেমন করে পূরণ হবে, ভেবে পাচ্ছিলাম না আমি। হেরেই গিয়েছিলাম মনে মনে এক রকম।” ভালবাসার বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে, মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রী ছিলেন শ্রেয়া। জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনা সব ওলোটপালোট করে দিল। কিন্তু তার পরেও, বাঁ হাতে এবং কিছুটা পায়ের সাহায্য নিয়ে পঞ্চম তথা চূড়ান্ত বর্ষের থিসিস পেপার এঁকে শ্রেয়া পাশ করেন ভাল রেজ়াল্ট করেই। এই পর্বের কথা বলতে গিয়ে শ্রেয়া বলেন, ‘‘সফটওয়্যারের সাহায্য নেওয়ার সুযোগ থাকলেও আমি সেটা নিইনি। বাঁ হাতেই এঁকেছিলাম সব ড্রয়িং।’’ স্নাতকোত্তর স্তরে আইআইটি রুরকিতে প্রথম সেমেস্টারেই প্রথম হয়ে জার্মানিতে গবেষণা করার সুযোগ পান শ্রেয়া। গবেষণা শেষে এখন তিনি নিজেই স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপিকা। বিয়েও করেছেন গত ফেব্রুয়ারিতে। ঘরবাড়ি গড়ার পাশাপাশি জীবনও গড়েছেন নতুন করে। এক হাতেই। যদিও শ্রেয়ার বন্ধুবান্ধবেরা টাকাপয়সা তুলে তাঁর জন্য একটি দামি রোবোটিক হাত আনিয়েছিলেন। কিন্তু তা ব্যবহার করতে পারেননি শ্রেয়া। কারণ ওই হাত পশ্চিমীদের শারীরিক গঠনের কথা ভেবে তৈরি। তাই ভারতীয় তথা এশীয়দের শারীরিক ধরন অনুযায়ী হালকা নকল হাত তৈরির জন্য গবেষণাও করতে চান শ্রেয়া। শ্রেয়ার এই লড়াই নিয়ে মারাঠিতে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে– জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস। সিনেমার পরতে পরতে উঠে এসেছে, শ্রেয়ারই জীবনের কথা। তবে তাঁর জীবন নিয়ে এমন সিনেম্যাটিক চিত্রনাট্য মোটেই পছন্দ হয়নি শ্রেয়ার। বলছিলেন, “কিছু কিছু সিনে আমার হাসিই পাচ্ছিল। আমার জীবনটা খুব কঠিন ছিল। সিনেমার মতো ঝকঝকে ছিল না মোটেই। অথচ সিনেমায় যেন সবই সুন্দর!” শ্রেয়া বোঝাচ্ছিলেন, তাঁর জীবন বা তাঁর লড়াই মানুষকে আজ যতই উদ্বুদ্ধ করুক, যতই তিনি বহু মানুষের চোখে হিরো হয়ে উঠুন না কেন, আসলে তাঁর সঙ্গে যেটা ঘটেছে, সেটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাই। এবং সেই দুর্ঘটনার যে চরম ক্ষত, সেটা মেনে নেওয়াটা তাঁর পছন্দ নয়, তাঁর বাধ্যতা ছিল। তিনি বলেন, “যে বদল এসেছে তাকে আমি লড়ে নিয়েছি মানে এই নয়, সেই লড়াই আমার করার কথা ছিল। আদতে আমি দুর্ঘটনারই শিকার। এটা প্রায়ই ভুলে যান অনেকে। এটা ভুলে গিয়ে, আমার বর্তমান সাফল্যগুলোকে অতিরঞ্জিত করেন।” শ্রেয়ার কথায়, “আজ আমি বহু নতুন আর্কিটেক্টকে পড়াই। আমি সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ওয়ার্কশপ করাই। আজও বহু মানুষের চোখে এটা ‘প্রতিবন্ধী মেয়ের সাফল্য’ হিসেবে থেকে গেলেও, আমি আমার কোনও প্রতিবন্ধকতা অনুভব করি না। আমি নিজেকে সম্পূর্ণই মনে করি। এবং বিশ্বাস করি, বাঁ হাতের জোরেই নিজের ভাগ্য নিজে লিখতে পারব আমি।”


 

Facebook Comments Box


Posted ৭:৫২ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ জুন ২০২১

শিক্ষার আলো ডট কম |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Blooming Child – Shamsun Nahar Zeba

(578 বার পঠিত)

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বু বৃহ শুক্র
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০৩১  
অফিস

১১৯/২, চৌগাছা, যশোর-৭৪১০

হেল্প লাইনঃ 01644-037791

E-mail: shiksharalo.news@gmail.com