মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার | সোমবার, ০৯ আগস্ট ২০২১ | প্রিন্ট
কুলাউড়ার উপর দিয়ে রেল ভ্রমণ করেছি বহুবার । তবে, একটি বারও মাটি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয়নি । ০২/০৮/২০১৭ খ্রিঃ দিন টি কেমন করে যেন হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলাম । তখন ও অফিসে বসে কাজ করছি । সকালে অফিসে প্রবেশ করেই মেইল চেক করা একটা রুটিন কাজ । বের হওয়ার সময় আবার চেক করি । সেদিন অফিস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে যখন মেইল চেক করলাম তখন মনটা অন্যরকম আনন্দে ভরে উঠলো । আগামীকাল উদ্ভাবনী ধারণা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আলোচনা সভায় মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা যেতে হবে । রাতেই ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর মহোদয়ের সাথে কথা বল্লাম । কারণ সভার স্থান কুলাউড়া ইউআরসি’র প্রশিক্ষণ কক্ষ । দশটায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা হলে ও নতুন জায়গা হিসেবে একটু আগেই পৌঁছার পরিকল্পনা করলাম ।
খুব ভোরে হবিগঞ্জ থেকে যাত্রা শুরু করে মৌলভীবাজার পৌঁছলাম । টমটম নিয়ে কুলাউড়া বাসস্ট্যান্ড যেতেই চলমান গাড়ী পেয়ে গেলাম । মনে হচ্ছে যেন গাড়ীটি আমার অপেক্ষায়ই দাঁড়িয়ে ছিল । নয়টা বাজার কিছু আগেই পৌঁছে গেলাম । তখনও দোকান পাঠ ওরকমভাবে খোলেনি । রাস্তায় রিক্সা চলাচল করছে ।অজানা জায়গা হিসেবে রিক্সা নিয়ে ইউআরসিতে চলে গেলাম ।
ওখানে ঢুকার আগেই পাশের একটি হোটেলে নাস্তাটা সেড়ে যখন ইউআরসির বারান্ধায় উঠলাম তখন জানালার পাশে একটু ঢুঁ মেরেই কেমন যেন দ্বিধায় পড়ে গেলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কার্পেট বিছানো । চারদিকে খুব পরিপাটি । প্লাস্টিকের ফুলে সুন্দর করে সাজানো গোছানো চমৎকার একটা অফিস । জুতা নিয়ে ভেতরে ঢুকবো না কি জুতা বাইরে রেখে ঢুকবো বুঝতে পারছিলামনা । প্রশিক্ষণ কক্ষের ও একই অবস্থা । শেষ পর্যন্ত ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর আফসানা আক্তার আসলেন । উনার সাথে কথা বলতে বলতে ভাল করে অফিসের চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ উনি বলে উঠলেন ‘চলেন বিদ্যালয়ের সমাবেশ এ যোগদান করি’ । অনেক মজা পাবেন ।
রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় । ইউআরসি সংলগ্ন । পাকা আঙিনা । ঠিক সামনে মরিচা ধরা পুরাতন টিনের ঘর । তবে, রুচিশীল ও পরিপাঠি সাজের জন্য দেখতে বেশ লাগছিল । উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে আছে বড় তিন তলা বিশিষ্ট ভবন । সমাবেশে আমরা উপস্থিত হলাম । ফর্সা হালকা লম্বা গড়নের একটি মেয়ে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে । বৃষ্টি তালি । দোয়েলের ডাক । মশা মারা , শারীরিক ব্যয়াম । জাতীয় সংগীত গাওয়ার আগে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত, গীতা ও বাইবেল থেকে পাঠ করে শোনালো শিক্ষার্থীরা । জাতীয় সংগীত গাওয়ার পর প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী শপথ বাক্য পাঠ করে শোনালো । অসম্ভব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছে সারাটা আঙিনা যেন উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে । শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে উৎসাহ উদ্দীপনার ছাপ স্পষ্ট ।
বিভিন্ন প্রকারের ব্যয়াম খুব চমৎকারভাবে করা হলো । ওয়েলকাম সং রেকর্ড বাজানোর সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা ও গেয়ে শোনালো । অনেক গুলো শারীরিক কসরত তারা চমৎকারভাবে দেখালো । দেখতে দেখতে হারিয়ে গেলাম । আমি ভুলেই গেলাম শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কক্ষে ও যে যেতে হবে। তারা যেন বিদ্যালয়ের আঙিনায় ই অনেক বেশী উজ্জ্বল অনেক বেশী প্রাণবন্ত ।
এত স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ আমি খুব কমই দেখেছি । চোখ জুড়িয়ে গেল । যখন গুডবাই সং টা গেয়ে গেয়ে শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কক্ষের দিকে পা বাড়ালো, মনটা কেমন আবেগ আপ্লুত হয়ে গেল । মনে হল আরো কিছুটা সময় যদি ওরা সমাবেশে কাটাতো ! আস্তে আস্তে অত্যন্ত শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কক্ষে চলে গেল । কিন্তু মনের কোণে কেমন যেন চিন চিন করে ব্যথা করতে লাগলো । আহা, সমাবেশটা যদি আরো কিছুক্ষণ উপভোগ করতে পারতাম !
এবার আমাদের লক্ষ্য প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি কক্ষ পরিদর্শন করা । উপরে উঠে দরজার কাছে যেতেই আমি তো অবাক । চার দিক অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো । চারটি কর্ণার খুব সুন্দর পরিপাটি । দেয়ালের গায়ে অনেক চমৎকার সব শ্রেণি উপযোগী ছবি আঁকা আছে । মেটের মধ্যে খুব সুন্দর হয়ে শিক্ষার্থীরা বসে আছে। পাঠদান কার্ক্রম শুরু হবে । এত চমৎকার করে সাজানো শ্রেণি কক্ষ দেখে ‘চোখ ফেরানো যায় তবু মন ফেরানো যায়না’।
এককথায় রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শ্রেণি কক্ষ সব পরিপাটি । যেন, ছবির মতো সাজানো । টিনের ঘরের পাশে শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো দেয়ালিকা । অসাধারণ লাগছিল । বিদ্যালয়ের যে জায়গায় দাঁড়াই সেখানেই নেশা ধরার মতো অবস্থা ।
মনে হল বিশাল একটা স্বপ্নের রাজ্যে নেশাগ্রস্ত লোকের মত অনেকটা সময় অতিবাহিত করলাম । উদ্ভাবনী ধারণা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আলোচনা সভা শেষে যখন ফিরে আসি তখন ও বিদ্যালয়টির প্রতিটা দিক আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে নেশার মত । সেদিনের কিছুটা সময় ছিল সোনায় মোড়ানো । সেসময়টুকু যে কর্মজীবনের প্রতি মুহূর্তের উপর প্রচন্ড ছাপ রেখেই চলবে সেটা বলাই বাহুল্য । ‘রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এর দ্যোতি ছড়িয়ে পড়ুক সারাদেশে ।
————————————————————————-
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।
শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।
Posted ৮:১৪ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৯ আগস্ট ২০২১
শিক্ষার আলো ডট কম | শিক্ষার আলো