বুধবার ২৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফনী দাস ।। মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার

মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার   |   বুধবার, ০৪ আগস্ট ২০২১ | প্রিন্ট

ফনী দাস ।। মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার

কড়া রোদের শুকনা গন্ধে নদীর দু‘পাড় মুখরিত হয়ে আছে । পিছনে পিচঢালা পথ এসে পায়ে হাঁটা মাটির রাস্তার গায়ে মাথা রেখে একেবারে শুঁটকী নদীর পাড়ে এসে থেমে গেছে । নদীর পানি বয়ে চলেছে নিরবধি, কিন্তু কোথাও কোন টু শব্দটিও নাই । মাঝে মধ্যে উভয় দিক থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা নদীর টলটলে স্বচ্ছ জলকে আন্দোলিত করে গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে । ঢেউ এর সাথে নদীর তলদেশের শেওলা গুলোও যেন দোলে উঠছে আপন মনে ।

নদীর উভয় তীরে পায়ে হাঁটার কাঁচা সড়ক, নদীর টলটলে স্বচ্ছ জলের মাধ্যমে দু‘ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে । দুই তীরের মধ্যে সম্পর্কের শিকল তৈরি করতে খেয়া নৌকার ব্যবস্থা আছে । ছাতা মাথায় অকপটে দাঁড়িয়ে লগি বৈঠা বেয়ে শুঁটকী নদীর দুই তীরের মধ্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে ফনী দাস । বিনিময়ে লোকজনের খুচরা টাকায় তার পকেট ভরে উঠে ।


হিসাবের খাতাটা সবসময় এক হয়না । কোন দিন তিন-চার‘শ আবার কোন কোন দিন হাজার টাকার দেখাও পেয়েছেন লগি বৈঠা বেয়ে । গ্রামের নাম জিজ্ঞাস করতেই হাসিমুখে উত্তর দিলেন । প্রতাপপুর এর আগের আমলেও একবার আসার সুযোগ হয়েছিল । প্রতিদিনকার যাত্রাপথে পশ্চিম দিকে চোখ ফিরালেই প্রতাপপুর গ্রামের দিকে নজর পড়ে । মোটর বাইক এক পাশে রেখে খেয়া নৌকায় পা রেখেই ফনী দাসের সাথে আলাপ শুরু করলাম ।

একটু আগে যে ইঞ্জিন চালিত নৌকা অতিক্রম করলো তার কলরব নদীর স্বচ্ছ টলটলে পানিতে এখনো যে তরতাজা রয়েছে খেয়া নৌকা দোলে উঠাই তার প্রমাণ । ফনী দাস বৈঠা হাতে নৌকাকে গতিময়তা দান করার চেষ্টা করছেন । মনে হচ্ছিল আমি ও গিয়ে তার সাথে নৌকা চালানোর কাজে সামিল হই । মনের কোণে ইচ্ছা জাগলেও পা আর এগোলনা একতিলও । ফনী দাসের বয়স পঞ্চাশের আশে পাশে হবে । তার কাছথেকে প্রতাপপুর সম্পর্কে সামান্য তথ্য জানার চেষ্টা করলাম ।


এবড়োখেবরো হয়ে গড়ে উঠা প্রতাপপুর গ্রামের প্রায় একহাজার ভোটার । লোক সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের উপরে হবে । সাতটা পরিবার ছাড়া বাকি সবাই মুসলমান । ফনী দাসরা সাত পরিবার কোন রকম তালমিলিয়ে টিকে আছেন প্রতাপপুর গ্রামে । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেল বন্ধনই তাদের ওখানে টিকিয়ে রেখেছে । তবে, ভিন্ন তথ্যও রয়েছে । প্রায় পঁয়ত্রিশটি পরিবার পাশের গ্রামের কিনারে বসতবাড়ি স্থাপন করে প্রতাপপুর গ্রাম ত্যাগ করেছে । কি যেন এক বিষয় নিয়ে তারা একই গোষ্ঠীর সকল পরিবার এখান থেকে পাত্তারি গুঠিয়ে ফেলে ।

ফনী দাসের চোখে মুখে কড়া রোদের দাগ মেখে আছে । নির্মেদ দেহখানা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবিরত মানুষকে এপাড়-ওপাড় করে ফিরছে । মাঝে একটা ছবি তোলার অনুমতি চাইলে স্মিত হেসে সায় দিলে আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করে ক্লিক করতে যখন ব্যস্ত, তখন ফনী দাসের খেয়া নৌকা প্রতাপপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে এসে ভীড়লো ।


চারদিকে জলবেষ্টিত অনেকটা দ্বীপের মত একখন্ড ভিটের মধ্যে চারদিকে সবুজ বনানীতে সুশোভিত এ বিদ্যালয়টি। এ যেন অনেকটা ইতালীর ভেনিস বন্দরের মতো মূল ভূখন্ডের সাথে একটা সড়ক দিয়ে সংযুক্ত করে রেখেছে। বিদ্যালয়ের চারপাশে ঠান্ডা পরিবেশ মনটাকে প্রশান্তিতে ছেয়ে ফেলেছে । পরিদর্শনের কাজ একটানা প্রায় আড়াই ঘন্টা করে যখন চোখ তোললাম তখন দেখি চমৎকারভাবে শিক্ষার্থীরা লাইন এবং ফাইলে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে । আমিও তাদের সাথে এসে যোগ দিলাম । প্রতিটা শিশুর চোখে মুখে স্বপ্নের বলীরেখা স্পষ্ট ভেসে উঠেছে । শিক্ষক দরাজ কন্ঠে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন । শিক্ষার্থীরা তা অনুসরণ করে সমাবেশের বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে এখান থেকে আগামী দিনের সমাজ, দেশ তথা জাতির কর্ণদার বের হয়ে আসবে।

প্রায় এক যুগ আগের দেখা প্রতাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রূপ-রস-গন্ধে ভরপুর হয়ে আছে। শিশুদের স্বপ্নময় রাজ্যে পরিণত হোক বিদ্যালয়টি । সুনাগরিক তৈরি হয়ে বের হয়ে আসুক সমাজের দেশের তথা রাষ্ট্রের কর্ণদার হয়ে । একদিন সে প্রত্যাশা পুরণ হবে এরকম আত্মবিশ্বাস মনেরমধ্যে পোষণ করে নিজের দপ্তরের দিকে পা বাড়ালাম ।

ফনী দাস আবারও নৌকা নিয়ে ঘাটে অপেক্ষা করছেন আমাকে অপর পাড়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য । নৌকা থেকে ডাঙায় যখনই পা রাখলাম রোদে পুড়া জলে ভেজা ফনী দাসের খেটে খাওয়া চেহারাটা আমার অন্তরে দাগ কাটলো । খেয়ার কড়ি আর হিসাব করলাম না, হা‌তের টানে যা আসলো ফনী দাসের হাতে গুজে দিয়ে বাইক স্টার্ট দিলাম । ফনী দাসের চেহারা চোখের সামনে দোলতে দোলতে অফিসে এসে পৌঁছে গেলাম । আমাদের প্রমোশন হয় যথা নিয়মে । কিন্তু ফনী দাসদের আর ইহজনমেও প্রমোশন হয়না । নৌকা-বৈঠা-লগি আর মানুষের পকেটের খুচরা পয়সাই তাদের পথ চলার একমাত্র অবলম্বন ।

শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।
—————————————————————————–
লেখক: মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
           ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার
           বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।

Facebook Comments Box

Posted ৮:১৫ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৪ আগস্ট ২০২১

শিক্ষার আলো ডট কম |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭৩০৩১
অফিস

চৌগাছা, যশোর-৭৪১০

হেল্প লাইনঃ 01644-037791

E-mail: shiksharalo.news@gmail.com