বৃহস্পতিবার ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সোনায় মোড়ানো সম্পর্ক যেন কাগজের মোড়কে বন্দি ।। মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার

মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার   |   মঙ্গলবার, ০৪ জুন ২০২৪ | প্রিন্ট

সোনায় মোড়ানো সম্পর্ক যেন কাগজের মোড়কে বন্দি ।। মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার

শৈশবে গ্রামের বাড়ির আঙ্গিনায় মাতিয়ে বেড়ানোর স্মৃতিটা আজো তাড়িয়ে বেড়ায় । আমার মায়ের ব্যবহারের একটা বাক্স ছিল যা আমার কাছে রীতিমত রহস্যময় মরন হত । সেটা কে ‘পেটি’ বলে ডাকা হতো । অত্যন্ত মজবুত এবং ছোট আকৃতির বাক্সের পেটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র রাখা হত । টাকা পয়সা, জমির কাগজ, পান-সুপারি, বিভিন্ন ধরনের কল কবজাসহ নানা ধরনের দ্রব্য এ বাক্সের মধ্যে সংরক্ষণ করা হতো । এক কথায় এটা একটা মাল্টিপারপাস বাক্স বলা চলে । কোন কোন বস্তু প্রায়ই রাখা হতো আবার প্রয়োজনের তাগিদে সেটা বের করা হত । এরকম কিছু দ্রব্যের অন্যতম হলো সুচি কাজে ব্যবহৃত জিনিস পত্র ।

আমার বড় বোনরা একসময় সেলাই কাজে মনোযোগী হয়ে গেলেন ।অবসরে নিতান্ত শখের বসে বড় সুচি দিয়ে উলের ‍সুতা ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার উপযোগী উলের বস্ত্র তৈরি করে নিজেরা ব্যবহার করতেন । মাঝে মধ্যে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে এসব কাজ দেখার চেষ্টা করতাম । একেতো বয়সে ছোট , তার ওপর নিজের অদক্ষতার জন্য বোনদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা খুব একটা ছিলই না। তার একটা কারণ হলো , ছেলে মানুষ আবার সেলাই কাজ শিখবে সেটা তাদের কাছে খুব প্রত্যাশিত ছিল না । বরং আমি দর্শক হিসেবে থাকব, আবার সহকারী হিসেবে এটা আন, ওটা রাখ এরকম ফরমায়েশ পালন করব এটাই বড় বিষয় ছিল আর সেজায়গাতেই আমি গ্রহণীয় ছিলাম । আমিও বিষয়টা খুব উপভোগ করতাম ।


তাদের সেলাই কাজের নানাবিধ সরঞ্জাম মায়ের সেই গুরুত্বপুর্ণ বাক্সের মধ্যে সযতনে সংরক্ষণ করা হত । শুধু যে উল বুনার সরঞ্জামাদি রাখা হত তা কিন্তু নয়। সাধারণ সেলাই এর সুই সুতাও সেখানে সংরক্ষণ করা হত । সাধারণ সুইগুলো কাগজের মধ্যে মুড়িয়ে রাখা হত । এ বাক্সটা আমার কাছে প্রচন্ড রহস্যে ভরা মনে হত । প্রায়ই চিন্তা করতাম যদি এর ভিতরে একবার চোখ বুলানোর সুযোগ পেতাম । মাঝে মধ্যে মা যখন বিভিন্ন প্রয়োজনে বাক্সটার তালা খোলতেন, আমি ঠিক পিছন পিছন গিয়ে একটু উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করতাম ভিতরের অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতটাকে । মাঝে মধ্যে নানা ছল ছুতায় বাক্সটা খোলে এর মধ্যে চিরুনী অভিযান চালাতাম । বাক্সটা নিয়ে কেন যে এত আগ্রহ সেটা আমি নিজেও জানি না ।

বাক্সটার ভিতরে একপাশে ছোট একটা ঝুলন্ত বাক্স তৈরি করা হয়েছিল যার নীচে অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছিল । এই বাক্সটাকে বলা হত ‘চোরকল’ । এটা কেন যে ‘চোরকল’ নাম ধারণ করলো সেটা তখন আমার কাছে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন ছিল । সম্ভবত লুকায়িত ক্ষুদ্র জিনিস গুলো রাখার জায়গা ছিল বলেই সেটা কে হয়তো ‘চোরকল’ বলা হত । আমার বোনদের সেলাই কাজের জিনিসপত্র ‘চোরকলে’র মধ্যে্ই রাখা হত ।


বেশ কিছু দিন যাওয়ার পর সেলাই কাজের আর কোন সাড়াশব্দ তেমন একটা পাওয়া গেল না । সেভাবেই আরো কিছুদিন অতিবাহিত হলো । একদিন মায়ের ‘পেটি’ খোলতেই নানা রকমের ঘ্রাণ আমার মনকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিল । ‘চোরকল’ এ চোখ পড়তেই কাগজে মোড়ানো একটা কিছু দেখতে পেলাম। আস্তে আস্তে হাতে তোলে নিয়ে মোড়ক খোলতেই মরিচা ধরা বেশ কয়েকটা সুই দেখতে পেলাম । সুই এর ধারালো মাথা মরিচা পড়ে অনেকটা মোটিয়ে গেছে । সুতো ঢুকানোর অংশটা ও মরিচা ধরে কেমন এবরোখোবড়ো অবস্থা তৈরি হয়েছে । হাতের আঙ্গুলের স্পর্শ করলে সেটা কেমন যেন অসমান মনে হচ্ছে । একটু ঘষা দিলেই আবার চকচক করে উঠবে । যত্নের অভাবে, কিম্বা ব্যবহার না করার প্রেক্ষিতে মরিচার আক্রমণে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার পথে।

সম্পর্ক গুলোও ঠিক ঘষামাজা না করতে করতে একসময় সেই কাগজে মোড়ানো মরিচা ধরা সুই এর মত অবস্থা হয়ে যায় । একদিকে সম্পর্কটা যত্ন করে কাগজে মোড়ানো সুই এর মত রাখা যায়, যা মরিচা ধরলেও হারিয়ে যাবে না । আবার সংরক্ষিত অবস্থায় থাকলেও তা কোন দিন কাউকে আহতও করবে না । যখন মন চাইলো কাগজের মোড়কের ভেতর থেকে বের করে এক নজর দেখা যাবে । সোনায় মোড়ানো অনেক আবেগ, যেন কাগজের মোড়কে বন্দি হয়ে আজীবন অক্ষয় হয়ে থাকে । যা একান্ত সম্পদ হয়েই ‘পেটির’ ‘চোরকল’ দখল করে থাকবে ।


শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

লেখক:
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।

Facebook Comments Box

Posted ৭:৪৩ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৪ জুন ২০২৪

শিক্ষার আলো ডট কম |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০  
অফিস

চৌগাছা, যশোর-৭৪১০

হেল্প লাইনঃ 01644-037791

E-mail: shiksharalo.news@gmail.com