
নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
১৪ সেপ্টেম্বর । ঠিক সতের বছর আগে এদিনটি আমার জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দেয় । এই দিনটা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে একা পথ চলতে হয় , একাকী চিন্তা করতে হয়, নির্ভরতার বাইরে এসে স্বনির্ভর হয়ে চলতে হয়, বটবৃক্ষের ছায়ার বাইরে এসে জাগতিক রোদ বৃষ্টি ঝড় ঝঞ্জা কীভাবে মোকাবেলা করে শক্তপুক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, কেমন করে নিজের মনে অসাম্প্রদায়িক ও উদার ভাবধারা পোষণ করতে হয় , সর্বোপরি পথ প্রদর্শকের অনুপস্থিতিতে নিজেই পথ খুঁজে নেয়ার উপায় বের করতে হয়, এসব ই এ দিন টা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে । আমার জীবনের বিশাল বৃক্ষ ছিলেন আমার বাবা মোঃ খুর্শিদ মিয়া তালুকদার এই দিনে আমাদের শূন্যতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে পরপাড়ে চলে যান ।
শৈশব থেকে আমার বাবাকে দেখে এসেছি সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কীভাবে সামনের কাতারে দাঁড়াতে হয়। আমাদের কৃষি নির্ভর এলাকা সব সময়ই বন্যা কিংবা শীলাবৃষ্টি অথবা উজানের পানির তুরে ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকতো সব সময় । বছরের পর বছর প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হত । একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অপর দিকে শ্রান্ত ক্লান্ত কৃষক এ দুই এর মধ্যে গ্রীষ্মের ক্ষেতের ফসল নিয়ে টানাটানি প্রায় প্রতিবছরই লেগে থাকতো । এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হাতে নেয়া হল সুরাইয়া-বিবিয়ানা প্রকল্প । এটা ছিল আমাদের এলাকার ভাগ্য নির্ধারণী প্রকল্প । এর সাথে জড়িত ছিলেন বাবু প্রমথেশ দাশ তালুকদার, জনাব মোঃ খুর্শিদ মিয়া তালুকদার, বাবু নিখিল চন্দ্র দাশ, বাবু সুকলাল রায়, বাবু শ্রীশ চন্দ্র দাশ । এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে লোকজনকে সংগঠিত করে প্রকল্পটি নিয়ে উপর মহলে কাজ করার জন্য জনমত গঠনে এবং লজিস্টিক সাপোর্ট আদায় করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । মার্কুলী থেকে ইনাতগঞ্জ পর্যন্ত এর প্রকল্প আজ লক্ষ মানুষের জীবন মান উন্নত করতে সহায়তা করেছে ।
অত্র এলাকাকে নগরায়ন করার কাজেও তিনি অসামান্য কর্মতৎপরতা দেখিয়েছেন। বোয়ালিয়া বাজার প্রতিষ্ঠা ছিল এর অন্যতম কৃর্তি । তখনকার সময়ে সাংঠনিক দক্ষতা দিয়ে দশ-পনের গ্রামের মিলনস্থল বোয়ালিয়া বাজার প্রতিষ্ঠা করেছেন ।
শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য ছিল । ধাইপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সরকারি অনুদান পাওয়া এবং জাতীয়করণ এর আগ পর্যন্ত বিভিন্নধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও কাজ করে সফল হয়েছেন। বিদ্যালয়টির দৈন্য দশা থেকে তুলে আনার প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে শিক্ষাদানের চলমান কার্যক্রমকে গতিসঞ্চারের প্রচেষ্টায় সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন।
ফকির মোহাম্মদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও নিরলস তৎপরতা চালিয়ে গেছেন । যেখানে ছোট একটা এড়িয়া নিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে আশপাশের জমির মালিকদের কাছ থেকে বিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে তিনি অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন যা তখনকার সময়ে খুবই দুরূহ কাজ ছিল ।
হাওর রক্ষার জন্য ইনাতগঞ্জ এ বিবিয়ানা নদীর মুখে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি সাহসিকতার সাথে কাজ করে গেছেন। পাঁচ গ্রাম থেকে পাঁচ/সাত’শ লোক নিয়ে ইনাতগঞ্জ এর বিবিয়ানা নদীর মুখে বাঁধ নির্মাণ করার জন্য অবস্থান করলে স্থানীয় লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে । অনুরোধ এবং কাকুতি মিনতি করে লক্ষ লোকের মুখের গ্রাস যাতে বানের জলে তলিয়ে না যায় সে জন্য বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় বাধাদানকারিদের সহযোগিতা কামনা করেন। স্থানীয় লোকজনের বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করে জনসমুদ্রকে নির্দেশ দিলেন কুদাল দিয়ে মাটি কেটে বাঁধ নির্মাণের জন্য । না খেয়ে মরার চেয়ে যুদ্ধ করে মরা অনেক ভাল । বানের জলে ফসল তলিয়ে গেলে তো না খেয়েই মরতে হবে , তাহলে সে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে যদি প্রাণ যায় যাবে । উনার নির্দেশ পেয়ে শতশত স্বেচ্ছাশ্রম দেয়া লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
দা, শাবল, কুন্তি, আর বন্দুকের গোলাবারুদ কুদালের কুপের কাছে ধরাশায়ী হয়ে পড়লো । এই সাহসীনেতৃত্ব দেখে স্থানীয় লোকজন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল । একদিনের মধ্যেই বাঁধ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলো সেই সাথে লক্ষ মানুষের মুখের গ্রাস রক্ষা করা সম্ভব হল । ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়ে জনমানুষের মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলেন ।
এলাকার দুস্কৃতিদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার সংগ্রামী ভূমিকা আজোও জনমনে তোলপাড় করে । একসময় জুয়া , মদ, গাঁজা, চোরি,ডাকাতি, রাহাজানির মত অসামাজিক কার্যকলাপে বাইশ গ্রাম সয়লাব হয়ে গিয়েছিল । এলাকার মুরব্বিয়ানের সহায়তায় বাইশ মৌজা বা গ্রাম নিয়ে একটা দুর্নীতি বিরোধী জোট গঠন করে অপকর্মকারীদের দমন করার ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা পালন করেন ।এজোট, নিরপেক্ষভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করে এলাকার অসামাজিক কর্মকান্ড তথা চোরি, ডাকাতি, রাহাজানী দমন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন ।
এলাকায় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অগ্র পথের সৈনিক । গ্রাম্য বিচার সালিসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে তিনি বঞ্চিতমানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন । এর প্রতিদানস্বরূপ সাধারণ মানুষ তাঁকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতো । নির্যাতিত মানুষের চোখের জল তাকে ভিতর থেকে নাড়া দিত । এ জন্য তিনি ন্যায় নিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবসময় আপসহীন ছিলেন ।
গ্রামের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তিনি সবসময় নিঃস্বার্থ এবং নিঃশর্ত ছিলেন। তিনি নিজের ব্যক্তিগত কোন বিষয়ই কখনোই বড় করে দেখেন নি । আপন স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে সবসময় সাধারণ মানুষের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রতিবেশীদের কেউ যদি অভোক্ত বা উপোষ থাকার কথা শোনেছেন, তখনই যতটুকু সামর্থ আছে তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এর উদারতাটুকু তিনি সবসময় যে কোন অবস্থায় দেখাতেন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । আমাদের চার পাশের ভিন্ন ধর্মালম্বী লোকজনের প্রতি তিনি ছিলেন বেহিসেবিভাবে উদার ও উন্মূক্ত । আমাদের গ্রামের হিন্দুধর্মালম্বীরা পুরো কার্তিক মাস জুড়ে নগর কীর্তন গাইতেন । আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে যাওয়ার সময় কীর্তন গেয়ে না গিয়ে বন্ধ করে লোকজন এপথটুকু অতিক্রম করতো অথবা অনেক সময় আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে না গিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে বিকল্প পথে কীর্তন গেয়ে চলে যেত ।
আমার বাবা বিষয়টি লক্ষ্য করলেন এবং সবাইকে এটুকু আশ্বস্ত করলেন যে, আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে কীর্তন গেয়ে গেলে আমাদের বিন্দুমাত্র সমস্যা বা আপত্তি নেই । সেই থেকে হিন্দু ধর্মালম্বীগণ আজ পর্যন্ত আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে যাতায়াত করার সময় তাদের ধর্মীয় আচার মেনে চলতে কোন দ্বিধা করেননি । এর জন্য আমাদের এলাকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আমার বাবাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন ।
উনার প্রয়াণের খবর শোনে আমাদের চেয়ে সাধারণ মানুষ খুব বেশী আশ্রয়হীন, খুব বেশী অসহায় হয়ে পড়েছিলেন বলে মনে হয়েছিল । জনাব মোঃ খুর্শিদ মিয়া তালুকদার তাঁর কর্মের মাধ্যমেই আজীবন মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন । তাঁর নীতি আদর্শ আজও আমাকে পথ প্রদর্শন করে যাচ্ছে ।
আজ তাঁর ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকী । আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ভাষায় বলতে হয়
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল ।
ওপারে যেন ভাল থাকেন , রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা । আমি আমার বাবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি । সবার কাছে তাঁর জন্য দোয়া কামনা করছি ।
শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।
————————————————————————–
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।
Posted ৮:৫৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
শিক্ষার আলো ডট কম | শিক্ষার আলো
আর্কাইভ
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৭ | |
৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১ | ১৩ | ৪ |
১৫ | ১৬ | ১ | ৮ | ১৯ | ২০ | ২১ |
২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২ |
৯ | ৩০ | ৩১ |