মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার | রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট
এটা ছিল আমার স্বাভাবিক যাতায়াতের রাস্তা । যখন কর্দমাক্ত কাঁচা সড়কের ছোট ছোট গর্তভরা গোলাটে পানি আর কাদা গাড়ির চাকার চাপে চার দিকে ছিটেকে পড়ে মাঝে মধ্যে পথচারির পরিস্কার ধবধবে সাদা কাপড় ময়লা হয়ে একাকার হয়ে যেত তখনও লোকজন হাসি মুখে চলন্ত গাড়ির ছন্দ এবং গতি হৃদয়ে অনুভব করতো । ভালমানের গাড়ী এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতো না বললেই চলে । চান্দের গাড়ী বা জীপ গাড়ী ছিল যাত্রীদের জন্য আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত । এসব গাড়ীতে আগে-পিছে চেপেচুপে বসে, আবার কোন কোন সময় গাড়ীর ছাদে বসে যাত্রীরা যাতায়াত করত । সেটা ছিল আমার শৈশবে দেখা নবীগঞ্জ টু হবিগঞ্জ রাস্তার যতায়াতের চিত্র ।
এখন আর সে দিনও নাই সে রাস্তাও নাই । এখন পিচঢালা পথ আর ভাল ভাল দূরপাল্লার গাড়ী হরিপুর এলাকার পরিবেশ কে আরো বেশী চটকধার করে তোলেছে । কর্ম জীবনে পদার্পণ করার পর এ পথটা আমার স্বাভাবিক যাতায়াতের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে । অন্য উপজেলায় কর্মরত থাকাকালীন হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলাধীন হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ( প্রথমে কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল পরে সরকারিকরণ হয়) যাত্রাপথে দেখে মনোবৈকল্যতায় ভোগতাম বার বার । মনে হতো এখানে বোধ হয় ঈশ্বরের সুদৃষ্টিটা আসতে আসতে অনেক আগেই সেটা ফুরিয়ে যায় , হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভাগ্যে আর সে দৃষ্টি ঝুটে না ।
যাত্রাপথে দেখা দৃশ্যের মধ্যে যা পড়তো, সে আর যাই হোক বিদ্যালয়ের চেহারা সুরত বলে মেনে নিতে কষ্ট হত । দরজা জানালার দৈন্য দশা , গরু-ছাগলের অভয়ারণ্য, অনাকাঙ্খিত লোকদের যাতায়াত, গবাদি পশুর বর্জপদার্থ, অরক্ষিত চেহারার মধ্যে ছিল এর চিরায়ত দৃশ্য । মূল রাস্তা থেকে বিদ্যালয়ের প্রবেশের মাঝে বিশাল ঢালু ও গর্ত যা অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে ঢুকতে হতো । তবে শুকনা মৌসুমে সেটা সম্ভব হলেও বর্ষায় খুব নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করতো ।
এ গাঁয়ে কিছু আদিকালের আত্মীয় স্বজন থাকায় দু’একজন বিদ্যালয়ের এ অবস্থা নিয়ে আমার সাথে বেশ আক্ষেপ করতেন , তখন সেটা আমার প্রাধিকারের বাইরে ছিল ।
কমিউনিটি বিদ্যালয় থেকে যখন সরকারি করণ হয় তখন বিদ্যোলয়টি যথাযথ পরিচর্যার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল । এর চারপাশের পরিবেশে বিদ্যালয়াটি ফুফিয়ে ফুফিয়ে শব্দহীন স্বরে যেন কান্না করতো । আমার যাত্রাপথে দেখা ইট-পাথরে গড়া বিদ্যালয়টি কেমন যেন তৃষ্ণার্ত, কেমন যেন বেদনার্থ চেহারা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে পথচারির দিকে তাকিয়ে থাকতো । আর , মনে মনে হয়তো অপেক্ষা করতো কবে আসবে এর যথাযোগ্য পরিচর্যাকারী । তার গায়ে হাত বুলিয়ে সকল ধূলি ময়লা দূর করে একটা চকচকে চেহারা ফিরিয়ে দিবে । চার দিকের পরিবেশে আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করবে ।
২০১৮ সালের মাঝা মাঝি সময়ে জনবলের দিক থেকে একটা পরিবর্তন সাধিত হল । পদোন্নতিপ্রাপ্ত একজন প্রধান শিক্ষক এসে যোগদান করলেন । কাকলী ইয়াছমিনকে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদানের পর থেকেই একরাশ শূন্যতা চার পাশ থেকে চেপে ধরলো । বৈরী পরিবেশ যেন কোনভাবেই সামনে আগাতে দিচ্ছে না । বিদ্যালয়ের গায়ে প্রাজ্ঞ হাতের শৈল্পিক স্পর্শ লাগার সাথে সাথে ইট-পাথরের পরতে পরতে নাড়াছাড়া শুরু হয়ে গেল । মাঝে মধ্যে পুরানো ফর্মা কঠিন করে বাধ সাদতে থাকে । প্রচন্ড বুদ্ধিমত্তা, একাগ্রতা, বিচক্ষণতা এবং নিজের পান্ডিত্য দিয়ে পুরো পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলেন ।
কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার পাশের কমিউনিটিকে নিজের কমিউনিটি হিসেবে গড়ে তোলা শুরু করলেন । সরকারি যত বরাদ্ধ আসতো সে টাকার যথাযথ ব্যবহার শুরু করলেন । মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব এডভোকেট আব্দুল মজিদ খান মহোদয়ের কাছ থেকে বরাদ্দ প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের খানাখন্দ ভরাট করে যাতায়াতের পথ সুগম ও মসৃণ করা হয় ।
বিদ্যালয়ের চেহারা ছবি পাল্টাতে থাকে দ্রুত গতিতে । নতুন অবকাঠামো তৈরি না হলেও পুরাতনের মাঝেই নতুন রূপ আরোপিত হলো । প্রধান শিক্ষকের কার্যকর যোগাযোগের প্রেক্ষিতে ক্যাচমেন্ট এলাকার লোকজন আস্তে আস্তে শিক্ষাবান্দব হতে শুরু করে । হাতধোয়ার জন্য পানির টেপ আছে বেশ কয়েকটা। শৌচাগারের নাজুক অবস্থা কাটিয়ে একটা চমৎকার চেহারা নিয়েছে । আপাদমস্তক একটা সুরক্ষিত বিদ্যালয়ের চেহারা ফুটে উঠেছে সারা গায়ে ।
চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে প্রতিটি কক্ষ । বঙ্গবন্ধু কর্ণার দেখে বেশ ভাল লাগলো । বিদ্যালয়ের বারান্দা গ্রিল দিয়ে ঘেরা , ইচ্ছা করলেই অযাচিত কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না । প্রধান শিক্ষকের টেবিলে বিভিন্ন ধরনের বই তার রুচিশীলতা এবং জ্ঞানপিপাসারই সাক্ষ্য বহন করে । শিক্ষার্থীদের অগ্রতিপরিকল্পণাও চমৎকার মনে হয়েছে । সর্বোপরি শিক্ষকমন্ডলীর মধ্যে টীম ওয়ার্ক এর চেতনা লক্ষণীয় ।
শিক্ষার্থীর হাজিরা বা শিক্ষার মানের দিকে থেকে যে কোন পুরাতন এবং ভাল মানের বিদ্যালয়ের সাথে হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুল্যমূল্য করা চলে । আমার যাত্রাপথে দেখা হরিপুর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর আজকের হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য ।
আগের এলাকা, কমিউনিটি, অবকাঠামো, ভৌগোলিক পরিমন্ডল সবই ঠিক আছে, কিন্তু পরিবেশ এবং পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং উন্নতির দিকেই যাচ্ছে ।
হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এভাবেই এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেটা খুব প্রত্যাশিত ছিল । একজন সফল প্রধানশিক্ষক হিসেবে কাকলী ইয়াছমিন যেমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তেমনি হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘুরে দাঁড়ানোটাও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটা ইতি বাচক পরিবর্তন । এভাবেই হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে । একজন কাকলী ইয়াসমিন প্রতিটি বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকুন এটাই প্রত্যাশা করছি।
[বিশেষ দ্রষ্টব্য : ১২/০৯/২০২১ খ্রিঃ তারিখে উক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শন করার সময় এসব পরিবর্তনের দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে ।]
শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।
লেখক :
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।
Posted ৯:১২ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১
শিক্ষার আলো ডট কম | শিক্ষার আলো