মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার | শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট
ছুটির দিনের আগের রাত সাধারণত দেরিতে ঘুমিয়ে সকালটা ও দেরি করেই শুরু করতে হয়। আজকের আশুরার বন্ধের ক্ষেত্রে তা কিছুটা ব্যতিক্রম। দশ থেকে বার ঘণ্টা ঘুমিয়ে চোখ মুখ যখন ফুলে থমথমে হয়ে যাওয়ার যোগার তখনই মায়ের কণ্ঠে নাস্তা খাওয়ার আহবান শোনে ঘুম ভাংতেই দেয়াল ঘড়িতে চোখ পড়ল। প্রায় নয়টা বাজলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নাস্তা সেড়ে যখন মনটা বাহির পানে টানছিল তখনই সঙ্গী হয়ে গেল বাইক আর দীপক।
বরাবরের মতই গন্তব্য অজানা। প্রখর রোদ গায়ের কাপড়কে কড়কড়ে করে তোললেও গা থেকে ধরধর করে ঘাম পড়তে লাগলো। আলাপ চারিতায় গন্তব্য ঠিক হয়ে গেল। শায়েস্তাগঞ্জ গিয়ে পশ্চিম দিকে মোড় নিতেই বড় সাইনবোর্ড এ লেখা দেউন্দি চা বাগান।
একটু বামে মোড় নিয়েই মাঝারি গতিতে বাইক চলতে থাকলো। কোন এক ফেইসবুক ফ্রেন্ড এর কাছে পদ্মবিল সম্পর্কে শোনেছে দীপক। যাত্রা সে দিকেই। আঁকাবাঁকা পাকা রাস্তা চলতে গিয়ে কয়েকজন লোকের কাছে জেনেই সোজা পদ্মবিলের পাড়ে এসে হাজির হলাম।
তিন দিকে চা বাগান উত্তরপূর্ব দিকে অনেকটাই খোলা মনে হল। লাল শাপলা গাছে বিলের পুরো জল ঢেকে আছে। প্রায় গোলাকৃতির জলাশয় পুরোটাই দূর থেকে মনে হল লাল পদ্মগাছে ভরে উঠেছে। কাছে যেতেই লাল শাপলার ফুটন্ত ফুল আর পরিণত কলি গুলো ঢ্যাবঢ্যাব করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। লাল শাপলাময় জলাশয়ে অপলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম।
বিলের পাড়ে গরু চড়াচ্ছেন এক শীর্ণ কায়ার লোক। নাম জিজ্ঞেস করতেই অবলিলায় সরলতা মাখা উত্তর পেলাম। আব্দুল হাই এর বয়স ত্রিশ থেকে বত্রিশ এর আশে পাশে।
আলাপচারিতায় তাই জানতে পারলাম। রোদে দগ্ধ হওয়ার ছাপ পুরো চেহারাকে গ্রাস করে স্থায়ীভাবে বসে আছে। পেশীগুলো যথেষ্ট মজবুত বলেই মনে হল। আলাপ করতে গিয়ে তার গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলাম। তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনে জারিগান বাজতেছে অবিরত। আশুরা সম্পর্কে সে যথেষ্ট সচেতন। জারিগান শোনতে শোনতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম।
আব্দুল হাই দিন মজুর । ট্রাকে বালু লোড-আনলোড এর কাজ করে তিন থেকে পাঁচশত টাকা রোজগার করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সংসারের ভার বহন করে চলছেন। দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। ভিটে ছাড়া ও পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া আধাবিঘা জমি তার সম্বল। কঠিন যুদ্ধ করে পরিবারে সদস্যদের মুখে খাবার তোলে দেন। টানাপোড়ানের মাঝে দিন কাটলেও তাতেই যেন তিনি তৃপ্ত। আজ আশুরা উপলক্ষে তার কাজ বন্ধ । তাই, মাঠে নিজের গাভী চড়াচ্ছেন।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার ৪নং পাইকপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্ধা আব্দুল হাই। সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা নেওয়ার চেয়ে নিজে গায়ে খেটে উপার্জন করে পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালাতেই বেশী পছন্দ করেন।
আলাপচারিতার সাথে চোখের সামনে লাল শাপলার পাপড়ি গুলো দোলে উঠছে। কখনো বাতাসের শন্ শন্ গতি শাপলা পাতাকে এবড়োখেবড়ো করে উল্টে দিচ্ছে। জলাশয়ের ছোট মাছ শেওলার ফাঁকে ফাঁকে গা ভাসিয়ে ফিরছে। আব্দুল হাই এর চেহারায় পরিশ্রমের ছাপ যেমন স্পষ্ট, তেমনি ইস্পাত কঠিন ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠতে দেখলাম তার কথার দৃঢ় উচ্চরণে। সরকারি সাহায্য নয় গায়ে খেটেই উপার্জন করে সংসার চালাতে চান তিনি।
জারিগানের করুণ ঝঙ্কার আর আব্দুল হাই এর জীবন সংগ্রামের কথায় পদ্ম বিলের ফুটন্ত ফুল গুলোও যেন বিবর্ণ হতে লাগলো। আজ তার কাজ বন্ধ । রোজগারের খাতা প্রায় শূন্যই । এ ফাঁকা টুকু ভরে দেওয়ার সাধ্যই বা আমাদের কতটুকু আছে। তাছাড়া নিজ গতর খেটে পথ চলার দৃঢ়তা দেখে তারদিকে হাত বাড়াতে প্রতিবন্ধকতার অজানা আশংকা দানা বেঁধে উঠছিল। একটু অনুমতি চাইতেই আমার ভয় কেটে গেল। তার আজকের সংগ্রামময় পথের কিছুটা হলেও সেতু বন্ধনের চেষ্টা করে পদ্ম বিলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
দশ মিনিট হালকা ড্রাইভ করতেই চমৎকার লেইক। এর মাঝে মাথা উঁচু করে সাদা পদ্ম ফুল আর পাতা সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। বাইকটা অদূরে পার্ক করে বিলের পাড়ে হাঁটা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে পরিষ্কার পানি দেখা গেল। চারদিকে চা বাগান আর ছায়াবৃক্ষ গুলো যেন লেইক টা কে পাহাড়া দিচ্ছে। তীরের কাছ ঘেঁষে সাদাপদ্ম গজিয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য ছিল চার পাশে ঘুরাঘুরি করে এর সৌন্দর্য উপভোগ করব।
কয়েকটা আফুটা পদ্মফুল হাতে তোলে নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর হালকাপাতলা লম্বা শারীরিক গড়নের বয়স্ক লোকের দেখা পেলাম। কাজ করছেন। সহজ সরল ভঙ্গিতে কথা বলছেন অরুণ বাগদি। বাগানে চৌকিদারী করে মাসে হাজার ছয়েক টাকা আর রেশন দিয়ে পরিবার চালান। তিন মেয়ের সবাই কে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলের একজন স্নাতক পাশ করে চেষ্টা করেও আনুকূল্য ক্রয় করার সামর্থের অভাবে শেষ পযর্ন্ত চাকরী টা নাকি আর হল না। নিজ হাতে কয়েকটা সাদা পদ্মফুল আর পদ্মের বিচি আমার হাতে তোলে দিলেন।
অপূর্ব লেকের চার পাশে সাদাপদ্ম যেন মন-প্রাণ আকর্ষণ করছিল। অরুণ বাগদি জীবন্ত ছোট মাছ দিয়ে বড়শী পেতেছেন। এই লেকে বড় মাছের ও নাকি দেখা মিলে। গত কালও নাকি প্রায় দুই কেজি ওজনের মাছ ধরেছেন আজও সেই প্রত্যাশা বুকে নিয়ে মাছ ধরার জন্য কৌশল অবলম্বন করছেন।
বাগানের পরিবেশে অরুণ রা যেমন নিজেদের জগত গড়ে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে তাদের ছেলে মেয়ে দুটি পাতা একটি কুড়ির সীমানা অতিক্রম করে মূলধারাতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে । কোন কোন প্রচেষ্টা সফল হয়, আবার কোনটা বা অঙ্কুরেই ঝরে যায়।
একদিন হয়তো অরুণ আর আব্দুল হাই রা ও সীমানা অতিক্রম করার স্বপ্ন দেখবে । আর সেই লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবে তাদের উত্তরসূরীরা। আমরা স্বপ্ন দেখি , তবে পদ্ম বিলের পাড়ের লোকজনের স্বপ্ন যেন স্পর্শহীন বর্ণহীন হয়ে কখনো সবুজের বেড়াজালে আটকা পড়ে, আবার কখনো জলাশয়ের মাঝখানে হারিয়ে যায়। এদের স্বপ্নকে তোলে এনে লালন করতে পারলেই আমরা সমৃদ্ধি ও সম্মানে আত্মমর্যাদাশীল জাতিতে পরিণত হব। সেই তিমিরের মাঝখানে আলো জ্বালানোর অপেক্ষা ই অরুণ-আব্দুল হাইদের মূল স্বপ্ন।
শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।
লেখক :
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।
Posted ৮:০৮ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
শিক্ষার আলো ডট কম | শিক্ষার আলো