মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার | সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট
স্মার্ট ফোনটা চূড়মার হওয়ার পর, মনে হচ্ছিল আর ওটা হাতে তোলে নিব না । খাটের বাক্সের এক পাশে ওটা এখনো আহত এবং মুমূর্ষূ অবস্থায় নিরবে সময় পার করছে । মনে আছে আমার, ভেঙ্গে যাওয়ার পরও একটা কল এসেছিল । কলার কে সেটা আর জানা হয়ে উঠেনি । হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কেউ অথবা সাধারণ এমন কেউ যার কলটা না ধরলেও তেমন কোন অভিযোগ মোকাবেলা করতে হবে না । গুরুত্বপূর্ণ কারো কল মিস হয়ে থাকলে নির্ঘাত তার বিরাগভাজন হতে হবে যা ইতোমধ্যে পুরানো হয়েও গেছে ।
একসময় স্মার্ট ফোন ছাড়া কল্পনাই করতে পারতাম না । ওটা ছিল জীবনের নিত্যদিনের অনুসঙ্গ । প্রিয়জনের সাথে সহজ যোগাযোগের একমাত্র উপায় । দিনে যে কতবার ফেইসবুকের নোটিফিকেশ , ম্যাসেঞ্জারের লেখা চেক করতে হত তার কোন সীমা ছিল না ।
ফোন টা অকেজো হলেও কথা বলার জন্য একটা বাটন ফোন খুব বেশী প্রয়োজন ছিল । অফিস সামাল না দিলে তো চলেই না । যদি ফোন ব্যবহার না করেই অফিসটা সামাল দিতে পারতাম, যদি ফোন ব্যবহার না করলে বড়কর্তার রক্তচক্ষু মোকাবেলা না করতে হত, তাহলে আমি সেটাই করতাম অন্তত ফোন ।
সবচেয়ে বেশী অনলাইনে থাকা একটা মানুষ কেমন করে যে অফলাইনের যাপিত জীবনকে মেনে নিচ্ছিলাম সেটা সত্যি অবাক করার মত । ইতোমধ্যে সরকারি স্মার্ট ডিভাইসও হাতে এসেছে একাধিক । সেটাকে ছুটিয়ে ব্যবহার করে জীবনটাকে দাপ্তরিক গন্ডিতে কেমন করে উপভোগ করতে হয় সেটা বোধ হয় আমার চেয়ে আর কেউ ভাল অনুভব করেনি ।
মনে হচ্ছিল ট্যাবলেট পিসি, ল্যাপটপ, টাচ মোবাইল এসব যেন অক্টপাসের মত চারদিক থেকে প্যাঁচিয়ে ধরছে । সবাই মুখে কথা না বলে লাইক কমেন্ট নিয়েই বেজায় রকমের খুশি । পাশে বসেই আছে , তারপরও যেন মুখে কথা নাই । কথা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে নির্গত না হয়ে আঙ্গুলের ডগার দিয়ে মোইলের পর্দায় ভেসে উঠছে । এটাই নাকি সামাজিকতা, এটাই নাকি সম্পর্ক । আবার বিভিন্ন ধরনের রিয়েক্ট করলে বা স্টিকার কমেন্ট করলেও সেটা পোস্টদাতার আনন্দ বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
আস্তে আস্তে বাস্তব জীবনকে যেন আমরা আর তোয়াক্কাই করছি না । ঝগড়া ফ্যাসাদ লাগানোরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সোশাল মিডিয়ার লেখা । সম্পর্ক তৈরিতেও সোশাল মিডিয়া অনেক কার্যকর । যে লাইক কমেন্ট করে সবচেয়ে সরব ভূমিকা পালন করে, মাঝে মধ্যে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলেও তাকে তত বেশী স্বঃস্ফূর্ত মনে হয় না, যতটুকু সোশাল মিডিয়াতে তৎপরমনে হয় । তবে, সোশালমিডিয়ার সম্পর্কের জের ধরে মানুষের অনেক গভীর পর্যায়ে চলে যাওয়ার নজির অহরহ পাওয়া যায়।
ওয়াটসআপ ম্যাসেঞ্জারে যে ব্যক্তি খুব বেশী ভাবের আদান প্রদান করে, পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও যেন অচেনা লোকের কাতারে চলে যায় । তাহলে বাস্তবতা আর ভার্চুয়াল লাইফ এক নয় ? অবশ্যই সেটা এক নয়, এক হতেও পারে না । তবে , দেশে যে নিরব পরিবর্তনের হাওয়া বইছে তাতে ভার্চুয়াল লা্ইফকে খুব একটা অস্বীকার করারও সুযোগ নেই । তার মানে হচ্ছে, আপনি পুরোপুরি ভার্চয়াল লাইফেই থাকবেন সেটাও যেমন কাজের কথা নয়, সেটাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করলেও জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হারাতেও হতে পারে । এটা অনেকটা তরকারিতে লবণ মেশানোর মতই । তরকারিতে অধিক লবণ মেশানোর ফলে যেমন খাদ্য অখাদ্যতে পরিণত হয়, তেমনি লবণবিহীন খাদ্যও বিস্বাদ হয়ে যায় ।
তাই, সমাজজীবন, পারিবারিকজীবন এবং কর্মজীবনে এখন স্মার্ট ফোন পুরোপুরি দখল করে আছে । একসময় বন্ধু বান্ধবের সাথে গল্প করা বা পাল্লা দেয়ার জন্য যে যত দামী মোবাইল সামর্থ অনুসারে কিনার চেষ্টা করতো । এখন সেটা প্রয়োজনের তাগিদেই কিনতে হচ্ছে ।
আজ নিতান্ত দাপ্তরি পরিমন্ডলে টিকে থাকার জন্য অনেকটা ভীষণ প্রয়োজনে স্মার্ট ফোন আবারো হাতে তোলে নিতে হল । স্মার্ট ফোনে যে নোটিফিকেশন চেক করতে বার বার স্ক্রিনের দিকে তাকাতে হত আজ আর সেটা করতে হয় না । প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে নোটিফিকেশন প্রতি সেকেন্ডে চেক করে নেই । মনের মধ্যে যে সব নোটিফিকেশন বাজে তাতে ভার্চুয়াল লাইফের চেয়ে খুব বেশী সাড়া পাই ।
যন্ত্র সবসময়ই পরাধীন আর মনটা সবসময় স্বাধীন । স্মার্ট ডিভাইস যেভাবে ব্যবহার করবেন সেটা সেরকমভাবেই ব্যবহৃত হবে । কিন্তু মনের মাঝে যে সুর বাজে সেটা শরীরের শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে শোনা যায় না , কিন্তু মনের শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে অনায়াসে শোনা যায় । স্মার্ট ফোনের নোটিফিকেশন এর মতই আজকাল মনের মধ্যে সারাক্ষণ টুংটাং করে নোটিফিকেশন আসার শব্দ বাজতেই থাকে । সেটা আজীবন চলবে , অন্তত মনকে জাগিয়ে রাখতে হয় কীভাবে , আবেগকে পোষে রাখতে হয় কেমন করে, সেটা স্মার্ট ফোনের কাছ থেকে শিখেই অন্তরে তা লালন করছি । সেই নোটিফিকেশন আর কোন দিন বন্ধ হবেনা, হওয়ার নয় ।
স্মার্ট ফোন যেন মনকে, চিন্তা-চেতনাকে আরো বেশী স্মার্ট করে যা মানুষের কল্যাণে লাগে , সভ্যতা যেন আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় এর ইতিবাচক ব্যবহারের মাধ্যমে।
শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।
লেখক: মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।
Posted ৭:৪২ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১
শিক্ষার আলো ডট কম | শিক্ষার আলো