
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার | শনিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট
ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক
ছুটির দিনটা সবসময়ই আমার কাছে খুব উপভোগ্যই মনে হয়। কেউ বেড়ানোর প্রস্তাব করলে সাধারণত না বলাটা আমার স্বভাবে নেই । যতই কাজ থাকুক , অপরিহার্য না হলে কোন ধরনের কাজই আমাকে আটকে রাখতে পারে না । তারপর যদি ছুটির দিন হয়, তবেতো কথাই নেই, একপায়ে খাড়া থাকি কেউ প্রস্তাব দিলে, অথবা নিজেই একটা বন্দোবস্ত করে খোলা আকাশের নীচে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারালে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সুযোগটা চমৎকারভাবে পাওয়া যায় । তাই, জীবনের একগুয়ে পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে, আনন্দঘন পরিবেশে সময় অতিবাহিত করে প্রকৃতিকে মাতিয়ে তুলে এবং নিজেও প্রকৃতির অপার সুন্দর্য কে উপভোগ করার মাধ্যমে জাগতিকতার বাইরে অবস্থান করে কিছুটা ফ্রেশ হয়ে নেয়া যায় , যেমনটা খালি হারিকেনে কেরোসিন ভরার মত । যাতে বাকি ক’টা দিন আলো জ্বালাতে খুব বেগ পেতে না হয় ।
যাহোক, যাত্রাপথের গন্তব্য ঠিক হল প্রায় পনের বিশ ঘন্টা আগেই । পরিকল্পনা মত সকালে রওয়ানা দিতে হবে । বানিয়াচং উপজেলার বিভিন্ন প্রান্থ থেকে ঊনিশজন এবং আজমিরীগঞ্জ থেকে একজন প্রধান শিক্ষক , উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইন্সট্রাক্টসহ মোট বাইশজনে বহর গিয়ে আজমিরীগঞ্জ মিলিত হব । গন্তব্য ‘গরীবের রাজপথ’ দেখা। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক যা বিশাল হাওরের বুকে সরীসৃপের মতেআঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে আছে ।
হবিগঞ্জ থেকে যাত্রা শুরু করতেই সিএনজি চালিত অটোরিক্সার সু সু করে চলার শব্দ সকালের পরিবেশকে অন্যরকমের ব্যঞ্জনা দান করছে । নরম রোদের চেহারা সময়ের ব্যবধানে কটকটে রুক্ষ ও কর্কশ হয়ে সমগ্র পরিবেশকে উষ্ণ করে তোলছে । হবিগঞ্জ অতিক্রম করার সাথে সাথেই কালার ডুবার অগভীর টলটলে জল চুম্বকের মত টানছে । আজকাল সাধারণ মানুষ নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য, প্রকৃতিতে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াস হিসেবে কালার ডুবাকে বেছে নিয়েছে । হবিগঞ্জ যারা অবস্থান করছেন তাদের কাছে কালারডুবার সদ্য নির্মিত চা/কফি হাউজগুলো একটা নতুন ক্রেজ হিসেবেই পরিগণিত ।
বিকালের তুলতুলে নরম রোদের মধ্যে সাধারণ মানুষজন ভীড় জমিয়ে চা, পুসকা, চটপটি খেয়ে হাওরের প্রকৃতিকে উপভোগ করে থাকে । বিকালে রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মোটর সাইকেল, টমটমসহ প্রাইভেট কার । পানাহারের তেমন কোন আহামরি বন্দোবস্ত না থাকলেও শুধুমাত্র নবনির্মিত সেতুর পাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে চোখ দিয়ে চেটে খাওয়ার লোভেই লোকজনের এত সমাগম হয়ে তাকে ।
ছন্দময় গতিতে আমাদের গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো । আজকাল হবিগঞ্জ-বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ রাস্তার স্মরাণাতীতকালের চেয়েও উন্নয়ন ঘটেছে । একসময় ‘হেমন্তে পাও(পা) এবং বর্ষায় নাও(নৌকা)’ ছিল আজমিরীগঞ্জের পথ চলার একমাত্র অবলম্বন । মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব এডভোকেট আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ খানের নিরলস প্রচেষ্ট এবং পরিকল্পনায় বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ এ একটা সুষ্ঠু ও সুন্দর সড়ক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে । বানিয়াচং থেকে বর্ষায় নবীগঞ্জ যেতে নৌকা ছাড়া কোন উপায় ছিল না । আজ সেটাও ইতিহাস । বিশাল সেতু আর পাকা সড়কের উপর ভর করে আজকের যোগাযোগ ব্যবস্থা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে উন্নতিলাভ করেছে । এর একচেটিয়া কৃতিত্ব বর্তমান সংসদ সদস্য মহোদয়ের ।
বানিয়াচং অতিক্রম করার প্রেক্ষিতে কুন্ডুরপাড় গেলেই আজমিরীগঞ্জ যাওয়ার দুটি বিকল্প রাস্তা রয়েছে, আমরা শিবপাশা হয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম । হাওরের পেঠে এবারের বর্ষার পানির আন্দোলন খুব একটা চোখে পড়ে না । ঘাস-গুল্মলতায় পানিকে অনেকটা কব্জা করে রেখেছে । একজায়গা কিছু লোক পাতলা গুছের ধান কেটে তোলার কাজে ব্যস্ত । মনে হলো বৈশাখের ধানের উত্তরাধিকার কে বেজন্মা ভেবে বাকি ধান বিদায় নিয়েছে । আর আগ্রহী কৃষক সেগেুলোকে পরম মমতায় আগলে ধরে পাহারা দিয়ে এখন কেটে ঘরে তোলছে । বিষয়টা আসলে তা নয় । আউশ ধান ফলানোর ক্ষুদ্র আয়োজনের ক্ষীণ প্রয়াস হাওরের এক পাশে দেখা গেল । অদূরে কিছু জেলেডিঙ্গি মাছ ধরার কাজে সময় অতিবাহিত করছে । হাওর যেন কোন সময়ই উৎপাদনের বাইরে নয় । শুকনা মৌসুমে ধান, আর বর্ষায় মাছের উৎস হিসেবে কাজ করে । কোন ভাবেই যেন হাওরের কোন বিরাম নেই ।
সামনে এগিয়ে যেতেই আকাশ কুচকুচে কালো বর্ণ ধারণ করতে শুরু করলো । আমাদের যাত্রাপথ কমতে শুরু করলো । হঠাৎ আকাশ ফেঁটে মুষলধারে বুষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগলো । প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আমরা আজমিরীগঞ্জ বাজারে একটা খাবারের দোকানে আশ্রয় নিতেই দেখলাম আমাদের টীমের আরো সদস্যগণ আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন। সকালের নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা গেল বৃষ্টি আর নেই ।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলা ভাটি বাংলার প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত । মাছ-সবজি-কলা এখানে খুব বেশী পাওয়া যায় । গরুরবাজার , কাঠের আড়ৎ, গরুরদুধের ছানার মিষ্টি ছিল এখানকার বিশেষ আকর্ষণ । ভাল দই এর আয়োজন এখানকার দোকানগুলো অনন্য উপাদান । দশ-পনের মিনিট সময় হেঁটে নদীর পারে যেতেই ফেরি-নৌকা তৈরি হয়ে বসে আছে আমাদের পারাপার করা জন্য । অনেকগুলো ফেরি-নৌকা নদীর তীরে ভিড়ানো । সারাদিন এপার-ওপার করেই তারা জীবিকার সন্ধান করে থাকেন । অন্য কোন উপায় না থাকায় জনসাধারণ ও পারাপারের জন্য ফেরি-নৌকা গুলোর উপর নির্ভরশীল ।
প্রায় দশমিনিটের মধ্যেই নদী পার হয়ে বিশাল কালনী নদীর গায়ের উপর আমার নজর পড়তেই ট্যাবলেট পিসি দিয়ে কয়েকটা ক্লিক করে নদীর পুরো শরীরটা ক্যামেরা বন্দি করেই সামনে দিকে পা বাড়ালাম । আমিরগঞ্জ বাজার কয়েবছর আগে গড়ে উঠেছে । বেশ জমজমাটই মনে হল । ব্যবসায়ীরা আলু-পটল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে আছে । আমরা আমিরগঞ্জ বাজারে রূপবৈচিত্র্য এবং নগরায়নের ক্ষুদ্র প্রয়াস যা নদীর তীর কে আরো বেশী সমৃদ্ধ করেছে তা দেখে একেবারে ট্রলারঘাটে চলে এলাম । বিশাল ইঞ্জিনচালিত নৌকা । ছইএর উপরে সামিয়ানা টাঙ্গানো । দুইপাশে বসার মত চমৎকার আসন সৌখিন মেজাজে তৈরি করা ।
নৌকার নীচের পরিবেশে নিজেকে একটু মেলে ধরার চেষ্টা করে শেষমেস ছই এর উপরে চলে এলাম । শুরু হল নৌকাভ্রমণের আসল মজা । একের পর এক গানের আয়োজন এবং মাঝে মাঝে চুটকী বলার রসাত্মক পরিবেশ হাওরের টলটলে স্বচ্ছ জল আন্দোলিত করে নৌকা ছুটে চলতে থাকলো সামনের দিকে ।
ঘোষণা দেয়া হলো আমরা আমাদের সমাজ, সংসার, দাপ্তরিক কাজ-কর্ম বা নিত্যদিনের পরিবেশ সবকিছু পিছনে ফেলে হাওরের জলো পরিবেশে আনন্দঘনভাবে নিজেদেরকে যার যার মত করে মেলে ধরার চেষ্টা করব । এতে, কোথাও যেন কোন সংকোচ বা দ্বিধার লেশমাত্র না থাকে ।
পরিবেশটা একেবারেই যেন উন্মুক্ত আর জড়তা মুক্ত হয়ে গেল । মনে হলো বাধাহীন গণ্ডিহীন মুক্তির উল্লাসে সবাই আমরা নেচে গেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি । কেউ গলা ছেড়ে গান ধরছে, কেউবা তাল-ছন্দ ঠিক রেখে হাততালি দিচ্ছে, আবার কেউ ননএকাডেমিক নৃত্যে নিজেকে হাওরের পরিবেশে উজার করে দিতেছে । কোথাও একটু মনোবৈকল্য কারো মাঝে দেখা যায়নি ।
‘বকুলফুল বকুলফুল সোনা দিয়া হাত কানো বান্ধাইলি’ গানটা একজনের কন্ঠে উঠাতেই সবাই যেন হুমরি খেয়ে পড়লো গানের প্রতিটি কথা কণ্ঠে ধারণ করার জন্য । হাত তালি দিয়ে গাইতে গাইতে সভা পুরোটাই মশগুল হয়ে উঠলো । হাওরের স্বচ্ছ টলটলে জলরাশির দিকে যতদূর চোখ যায় মাঝে মধ্যে কোন কূল কিনারা খুব এটা দেখা যায় না । আবার কোন কোন জায়গায় পানির সাথে যুদ্ধ করে ছোট ছোট গ্রাম গুলো পাথরের মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে ।
ছোট ছোট ঢেউ শিশুর মত খেলতে খেলতে বাড়িগুলোর ঘাটের উপরে হালকাভাবে আছড়ে পড়ছে । মনে হচ্ছে কোন ধরনের সন্ধি করা আছে পানি আর ঘাটের মধ্যে, তাই মায়াবী আলতু ছোঁয়ার মাধ্যমেই ঢেউ গুলো ঘাটের বুকে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে ।
কিছু এগিয়ে যেতেই ‘ মধু হই হই আঁরে বিষ হাওয়াইলা ‘ গানটির মাঝে সকল বোদ্ধারা নিজেকে মজিয়ে আকাশ বাতাস আর টলটলে জলকে আন্দোলিত করতে লাগলেন । গানের সুর আর হাততালি কিম্বা শরীর দোলানোর নান্দনিকতায় পুরো পরিবেশটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো । সামনে লোকালয় আস্তে আস্তে স্পষ্ট রূপ ধারণ করা শুরু করলো । মনে হলো আমরা ইটনা উপজেলায় চলে এলাম । এবার নৌকা ছেড়ে পাকা সড়কে পা রাখতে হবে ।
রাস্তায় টমটমের ভীড় দেখা যাচ্ছে । ঘুরে বেড়ানোর জন্য এটাই সবচেয়ে সহজ যানবাহন । দুইজন মোটর সাইকেলে করে আর বাকিরা টমটমে করে রওয়ানা দিলাম । ইটনার আড়াল থেকে বের হতেই বিশাল হাওরের বুকে রাজপথসম বিশাল সুউচ্চ রাস্তা চোখ ধাঁধিঁয়ে দেয় । ইটনার জিরো পয়েন্টে দাঁড়াতেই রোদের প্রচন্ড দাপটে কিছুটা কাবু হয়ে গেল অনেকেই । তারপও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সুযোগটা কেউ হাতছাড়া করেনি ।
হাওরের তিন ধরনের অবস্থা সারা বছরে দেখতে পাওয়া যায় । বর্ষায় বিশাল জলরাশি হাওরের বুককে দৃশ্যত পুরো সমতল করে তোলে । শুকনো মৌসুমে ফসলের সবুজের সমারোহে দর্শকদের হাওরের বুকে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে । ফসল যখন পেকে সোনালী বর্ণ ধারণ করে, তখন পুরো ফসলের মাঠ যেন সোনাময় হয়ে উঠে ।
ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক হাওরের পেঠের ভিতর বিশাল সরীসৃপের মত আঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে রয়েছে । হাওরের স্বচ্ছ জলরাশি পুরো রাস্তাটাকে দুইপাশ থেকে যেন চেপে ধরেছে । আপদমস্তক পাকা রাস্তা বীরদর্পে একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যেন জলের বেফাঁস নৃত্যকে সে কোন কেয়ার করছে না । সামনে উভয়পাশে অনুন্নত গ্রামের চেহারার মাঝে এখনো রাস্তার রাজকীয় জৌলুশ ফোটে উঠছে না। রাস্তার আর গ্রামের দিকে তাকালে মনে হয় এটা ‘গরীবের রাজপথ’ যেন পরম মমতায় হাওরের স্বচ্ছ টলটলে জলরাশি খুব জোর করে রাস্তাটাকে হাওরের বুকে ভাসিয়ে রাখছে ।
বর্ষায় বড় কোন গাড়ীর দেখা পাওয়া যায়না । শুকনো মৌসুমে ঢাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ প্রতিস্থাপিত হয় । কিন্তু, বর্ষার চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন । দূরে পিচঢালা পথের দিকে তাকালে মনে হয় মরুভুমর মরিচিকা যেন খেলা করছে । কাছে গেলেই সেটা উধাও হয়ে যাচ্ছে । বালুর ক্ষুদ্রক্ষুদ্র স্বচ্ছ পিঠে সূর্যর আলো পড়ে অনিন্দসুন্দর আলোকছটা দূরের পিচঢালা রাস্তার মধ্যে ভেসে উঠে । দূর থেকে সেটাকে জলের নহর ভেবে ভ্রম হবে ।
মোটর সাইকেল আর টমটম চলছে নিয়মিতভাবে । কিছু দূর যেতেই বেশ চওড়া ঢাকি সেতুর দেখা মিলল । টমটম এবং মোটরসাইকেল থামিয়ে সেতুর উপর থেকে নীচের স্রোতস্বিনীর দিকে তাকালে অপার সৌন্দর্য দর্শকের চোখ কে বিস্ফারিত করে তোলে ।
আরো একটু এগিয়ে যেতে মাঝারি গুছের আরেকটা সেতু সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছা করে শিল্পীর তৈরি লম্বা একটা অজগর পাথর দিয়ে নির্মাণ করে হাওরের পেঠে ছেড়ে দিয়েছে । আর সেই অজগরের উপর দিয়ে সাধারণ মানুষ মনের সুখে যানবাহন নিয়ে চলাফেলা করছে ।
কাকচক্ষুর মত টলটলে শীতল জল যখন পাথুরে অজগরের গায়ে আছড়ে পড়ে তখন সেটা যেন অদৃশ হুংকারে ফেটে পড়ে, যার আলামত চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা যায় না, সেটা অন্তর্চক্ষু বিস্ফারিত করলে অনায়াসেই দেখতে পাওয়া যায় । যারা হাওর দর্শনে এসে থাকেন, তারা নিশ্চয়ই এই পাথুরে অজগরের হুংকার কানপেতে শোনেন । পাথুরে অজগরের পিঠটা অনেকটাই কেউটের মত কালছে । পিচঢালা রাস্তার পিঠ অনেকটা কালো কেউটের পিঠের মতোই হয় ।
এবার সামনে মিঠামইন জিরো পয়েন্ট । উপছে পড়া দর্শকের ভীড় । চটপটি পুসকা, চা-চানাচূরের দোকানের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা । কিছু লোক বাড়তি আয়ের আশায় এবং দর্শকের সৌখিন মেজাজে সান দেয়ার জন্য ঘোড়া চড়ার সুযোগ করে দিয়েছে । নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা পরিশোধ করলে কিছু ক্ষণ আয়েসি ভঙ্গিতে ঘোড়া চড়ে বেড়ানো যায়, ছবি তোলে সেটা স্মৃতি হিসেবে রাখা যায় ।
মিঠামইন গেলেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি গণমানুষের নেতা জনাব আব্দুল হামিদ এডভোকেট এর বাড়ি দেখার জন্য উৎসুক জনতা ভীড় জমায় । ওখানে পৌঁছার পর যেন উপচে-পড়া দর্শকের জন্য নিরিবিলি কোন পরিবেশ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন । হাওরের মাঝখানে রাস্তা নির্মাণ করে যত না যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে, তারচেয়ে বেশী পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দর্শকের কাছে বেশী আদরনীয় হয়ে আছে । দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন হাওরের পেঠে জেগে উঠা পাথুরে অজগরের মত রাস্তা দেখা জন্য প্রতিদিন ভীড় জমাচ্ছে । এ ধরনের জনসমাগমের প্রেক্ষিতে এখানকার অর্থনীতিতে যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে । ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে খাবারের হোটেল গুলো চমৎকার আয়োজন করে পর্যটকদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করার জন্য ।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়িতে যাওয়ার সুবাদে ওখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য জনাব রেজুয়ার হাসান তৌফিক ( মহামান্য রাষ্ট্রপতির ছেলে) মহোদয়ের সাথে উক্ত টীমের সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয় । তিনি শত-ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের আদর আপ্যায়নের খুঁজ খবর নিয়েছিলেন । এটা এ ভ্রমণকে অন্যরকম মাত্রা যোগ করেছে ।
পড়ন্ত বিকেলে আবারো মিঠামইন জিরো পয়েন্ট হয়ে অষ্টগ্রামের দিকে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ারই বিশাল উঁচু ভাতশালা সেতু । গাড়ি আস্তে আস্তে যখন উপরের দিকে উঠতে থাকে মনে হল পাহাড়ের চূড়ায় আমার উঠতে শুরু করেছি । ঠিক মাঝামাঝি অবস্থায় গিয়ে যখন সেতুর গায়ে পা রাখলাম, মনে হল সমস্ত হাওর আমাদের পায়ের নীচে এসে কুর্নিশ করছে । হাওরের স্বচ্ছ টলটলে জলরাশি যেন অদৃশ্য ও অশ্রুত গর্জনের মাধ্যমে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে । ছোট ছোট ঢেউ যেন কলকল ধ্বনি করে স্রোতের বিপরীতে উঠে আসতে চাইছে ।
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে । পূর্ব দিকে তাকালেই প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট, তা দেখে প্রশান্তির ছায়া দুচোখের পাতাকে খুব বেশী জড়িয়ে ধরে । মনে হচ্ছে পুরো বিকাল যদি এখানে কাটিয়ে দেয়া যেত খুব একটা মন্দ হত না । খুব বেশী সময় ক্ষেপন করার কোন উপায় নেই । চর্মচোখ দিয়ে যে সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় , অন্তর্চক্ষু দিয়ে তার কয়েকগুন বেশী সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় । আমরা অন্তর্চক্ষু দিয়ে হাওরের অপার সৌন্দর্য চেকে নিতে লাগলাম ।
হাওরের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বর্ষায় অন্তত একবার হলেও ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক দেখার জন্য সকলেরই যাওয়া উচিত । তবে সেখানে গিয়ে দিনে দিনে ফিরে না আসতে পারলে হোটেল না থাকায় আবাসন সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনা রয়েছে । তাই এ সম্ভাবনাময় পর্যটনকে আরো বেশী প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে এখানে আবাসিক হোটেল নির্মাণ করা সময়ে দাবী । তারপরও হাওরের চিরায়ত রূপসৌন্দর্য দর্শকমনে চিরকালই দোলা দিবে । বাঙলার অপার রূপসৌন্দর্য যেন বর্ষার গা জোড়ে নেমে এসেছে সমস্ত হাওরের বুকে ।
এবার ফিরে যাওয়ার পালা । আপার জলো-সৌন্দর্যর লীলাভুমি এ হাওর অঞ্চল অদৃশ্য সুতো দিয়ে দর্শককে বেঁধে রাখতে চায় । হাওরের স্বচ্ছ জলরাশির টান সামাল দিতে না পেরে অনেক পর্যটক হাওরের জলে সাঁতার কেটে হৃদয় ও মন দুটোই জুড়ানোর চেষ্টা করেন । যেন জলো পরিবেশে নিজেকে সপে দিয়ে হাওরের রূপসৌন্দর্যকে সারা দেহ মন দিয়ে চেকে দেখছেন ।
এবার সন্ধ্যার হাওরের রূপ দেখে ফিরে আসার কোন টানই যেন মনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না । তারপরও ফিরতে হবে , ফিরে যেতে হয় । মিঠামইনের জিরো পয়েন্ট হয়ে একেবারে ইটনার জিরোা পয়েন্ট এ এসে হাওরপারের সন্ধ্যাকে ছুটিয়ে উপভোগ করে সোজা ইঞ্জিন চালিত নৌকায় উঠে আজমিরীগঞ্জ হয়ে আমরা সবাই যার যার বাসস্থানে ফিরে গেলাম । মনে হচ্ছিল ‘এ পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলতো ।’
শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।
লেখক:
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার
বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।
Posted ৭:৫৯ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
শিক্ষার আলো ডট কম | শিক্ষার আলো
আর্কাইভ
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | |||||
৩ | ৪ | ৫ | ৭ | ৮ | ৯ | |
১০ | ১১ | ১ | ১৩ | ৪ | ১৫ | ১৬ |
১ | ৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ |
২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২ | ৯ | ৩০ |
৩১ |