শুক্রবার ১৫ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩১শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কেন্দুফা’র রন্ধ্রে রন্ধ্রে ।। মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার

মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার   |   বৃহস্পতিবার, ০৫ আগস্ট ২০২১ | প্রিন্ট

কেন্দুফা’র রন্ধ্রে রন্ধ্রে ।। মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার

বানিয়াচং যোগদানের পর থেকেই বিশাল হাওর আমাকে চুম্বকের মত টানে।হাওরের শন শন বায়ুসৃষ্ট উত্তাল ঢেউ , ঝির ঝির বৈকালিক জলো হাওয়া, টুক টুক করে হাওরের মাঝ খানে এগিয়ে চলা জেলে নৌকা, কখনো বা পাল তোলা নৌকা মনের মাঝে দোলা দেয় । আমার কাজের প্রকৃতিই আমাকে টেনে টেনে নীল আকাশের বর্ণিল পরিবেশে নিয়ে আসে। এমনিতেই ঘুরে বেড়ানোর নেশা তার উপর আবার বাইরের বিশাল পরিবেশে কাজ করার সুযোগ, এ দুই মিলে চমৎকার আবহ মন কে ভরপুর করে তোলছে ।

প্রতিদিনের যাত্রা পথে পশ্চিম দিকে নজর পড়লেই মনটা শুধু আনচান করতো।আমার যাত্রাপথের অবস্থান থেকে কয়েক মাইল দুরত্বে যা দেখা যায়, মাঝখানের ফাঁকা অংশ জুড়ে বিশাল জল রাশিকে ছাপিয়ে উঠার ইচ্ছা সচরাচর জেগে উঠেনি ।


তবে, আজকের দিনটি ঠিক অন্যরকম । মোটর বাইক নিত্য সঙ্গী ।পাকারাস্তা দিয়ে সু সু শব্দে মোটরবাইক চালাতে গিয়ে হাওরের মাঝখানে চলে যেতে ইচ্ছা করলো । পাথারিয়ার কাছাকাছি যেতেই উত্তর দিক দিয়ে পাকা রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই আমার অনুমানের সাথে মিলে গেল। বাইক গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া যাবে না । তাদের কথা মতো পাকা রাস্তা শেষ হওয়ার আগেই মোটরবাইক একটা ঘরের পাশে লোকজনের অনুমতি নিয়ে রেখে দিলাম ।

কাঁধে ল্যাপটপ। পায়ে হেঁটে অগ্রসর হলাম।কিছুদূর যেতেই পাকা রাস্তা শেষ। এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা । বুঝাই যায় আধুনিক সভ্যতার দিকে যাত্রার প্রারম্ভিক পর্যায়ে রয়েছে। সামনে দূরে তাকালে তার বিহীন বিদ্যুতের খুঁটি নিরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।রাস্তার দুপাশে বিশাল জলরাশি।দু দিকের জল রাস্তাটাকে চেপে ধরছে মনে হল।রাস্তার উঁচু-নিচু অংশ ক্রমশঃ অতিক্রম করছি । ঠিক দশ মিনিট হেঁটে লোকালয়ের দেখা পেলাম। মনে হল যাতায়াতের জন্য তৈরি করা রাস্তা দিয়ে আধুনিক সভ্যতা এসে কেন্দুফার কেন্দ্রে প্রবেশ করেছে ।


গ্রামটির নাম কেন্দুয়াবহ স্থানীয় লোক জন একে কেন্দুফা বলেই পরিচয় করিয়ে দেয়। আমার কাছেও কেন্দুফা নামটা বেশ লাগছে । মাটির রাস্তা যেখানে শেষ ঘরবাড়ীর শুরু ঠিক সেখান থেকে।অগ্রসর হতেই কিছু যুবক কে আড্ডায় ব্যস্ত থাকতে দেখলাম। কেন্দুয়াবহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান জানতেই অত্যন্ত সহজ সরল ভাবে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে দিল। ছোট একটা ধন্যবাদ দিয়ে অগ্রসর হলাম । পা চলার সাথে সাথে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম চারদিকে । চোখ দিয়ে চেটে চেটে সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম। দুই পাশে সারি সারি টিনের ঘর মাঝে মাঝে হাফওয়াল এর ঘর ও দেখতে পাওয়া যায়। বেশীর ভাগ বাড়ীতে ফুলের গাছ লাগানো আছে । বলা যায় ফুল-বেল-তুলসি গাছ নেই এমন বাড়ী খুব কমই দেখতে পেলাম।বাড়ীর পাশের ঢালু জায়গায় গরুগুলো বেঁধে রেখে ঘাস ও শুকনো খড় দেয়া আছে । প্রাণী গুলো দাঁড়িয়ে খুব আয়েশ করে খাবার গ্রহণ করছে ।

দেবতা ঘর দেখলাম অনেক বাড়ীর আঙিনায়। হঠাৎ কানে ভেসে আসলো এক,দুই, তিন, চার, পান, ছক্কা।বুঝা গেল অবসর সময়টুকু লুডু খেলে পার করা হচ্ছে। আবার কিছুদূর অগ্রসর হতেই গানের সুর কানে ভেসে আসলো। তবে লোকজন চোখে পড়েনি মোটেও ।


গ্রামের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অলস বর্ষা খুব ঝেঁকে বসেছে।প্রায় ছয়মাস এরা বেকার হয়ে অলস সময় কাটায় । কাজের মাঝে গৃহপালিত গোবাদি পশু হাসমুরগীর যত্ন নেওয়া আর অলস আড্ডা দিয়ে সময় পার করা ছাড়া খুব একটা ব্যস্ততা আছে বলে আমার মনে হল না । তবে, কিছুলোক যে হবিগঞ্জ শহরে জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন কিছু করছে না তা কিন্তু নয়।এ সুযোগটাও হয়তো অনেকেই কাজে লাগাবে ।

ঘরের ডানে বামে, এপাশে ওপাশে, আগে পিছে অগ্রসর হয়ে সামনে যেতেই মাইকের ছাতা ঝুলানো দেখতে পেলাম। মনে হলো মসজিদের মাইক । মুসলমান পারিবার ও আছে তাহলে ! ওখানে পঁচাশি পঞ্চাশের বাহাস চলে। অর্থাৎ হিন্দু পরিবার পঁচাশিটি আর মুসলমান পরিবার পঞ্চাশ টি ।

সামনে যেতেই একটা নয় দশবছরের বালকে পেলাম । বিদ্যালয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই কাছাকাছি আছে বলে জানিয়ে দিলো। তার নাম জিজ্ঞাস করে জানতে চাইলাম কোন ক্লাসে পড়ে ।
পঞ্চম শ্রেণী বলতেই জিজ্ঞেস করলাম – আজ স্কুলে যাবে না ?

তার মা নাকি গত রাতে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন তাই আজ তার বিদ্যালয়ে যেতে মানা। আমি একটু মুখ টিপে হাসলাম । কথা বলেই সে বিদ্যুৎ বেগে আমাকে অতিক্রম করলো । আমাকে ছেড়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে । কিছুক্ষণ পর পাখির কল-কাকলির মতো শিশুদের কলরব কানে ভেসে আসলো। কিছু জায়গা অতিক্রম করতেই সুরম্য দুতলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে । আগে পিছে বিশাল জলরাশি। পাশেই ঘরবাড়ী । পূর্ব দিকে তাকালেই কালার ডুবা ।

বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষ করে ফেরার পথে অগ্রসর হলাম। পথে আসার সময় নানা দৃশ্য মনকে যেমন আলোড়িত করছিল বিদ্যালয় পরিত্যাগ করার মুহূর্তে সে অবস্থা একেবারে ফিকে হয়ে গেল । আবারো বিশাল জলরাশির দিকে নজর গেল । মোবাইল বের করে কয়েকটা ক্লিক দিয়ে দৃশ্যটা ধরে রাখার চেষ্টা করলাম । শত কষ্টের মাঝে ও মন টা কে প্রফুল্ল রাখতে হয় । সবখানে সবসময় মনের মত সবকিছু আশা করা যায়না, করলে তা পাওয়াও যায় না।

গ্রামের শেষ প্রান্তে যখন আসলাম দুজন লোক পানিতে সাঁতার কাটছে । অনুমতি নিয়ে ছবি উঠালাম । তাদের কাছেও বিষয়টা খুব আমোদপূর্ণ বলেই মনে হল । তাঁদের জিজ্ঞাসা ছিল বিদ্যালয়ে কি কাজে গিয়েছিলাম । আমি ইচ্ছা করেই খুব অস্পষ্ট জবাব দিলাম । কিছু একটা বলে অতিক্রম করে গেলাম ।

এবার ‘ফেলুন’ ( ঠেলা) জাল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য আমাকে আকৃষ্ট করলো প্রচন্ড রকমের । দাঁড়িয়ে মাছ ধরার দৃশ্য দেখলাম কিছুক্ষণ। সাথে সাথে ছবি ও তোলে নিলাম।প্রশ্ন করতেই জবাব পেলাম সে একটা মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে।সে আপন মনে মাছ ধরতে লাগলো আর আমি দেখে দেখে চোখ জুড়িয়ে নিচ্ছিলাম ।

এবার সত্যি সত্যি কেন্দুফা অতিক্রম করার পালা । আঁকা বাঁকা মেটু পথ এসে যখন পাকা রাস্তায় যুক্ত হলো, মোটর বাইকের তখন আমার ফিরে আসার প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হল ।

গাড়ী স্টার্স্ট দিতেই সামনের রাস্তা কমতে কমতে মূল গন্তব্যে ফিরে এলাম। কেন্দুয়া বহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মনটা পড়ে থাকলো । অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার বিশাল সুযোগ টা অনেক দিন যাবত মনের রাজ্য দখল করে রাখবে।

শিক্ষার আলোর ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।
———————————————————————————-
মোহাম্মদ জাহির মিয়া তালুকদার
ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।

Facebook Comments Box

Posted ৮:২৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ আগস্ট ২০২১

শিক্ষার আলো ডট কম |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১  
অফিস

চৌগাছা, যশোর-৭৪১০

হেল্প লাইনঃ 01644-037791

E-mail: shiksharalo.news@gmail.com